রাজনৈতিক সততার উজ্জ্বল ও বিরল এক দৃষ্টান্ত সৈয়দ আশরাফ

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বাংলাদেশের অসাধারণ একজন রাজনীতিবিদ। সততা, আদর্শ, বিনয় সবদিক থেকেই অসাধারণ। ক্ষমতায় গেলে অন্য প্রায় সবার সম্পদ যখন হু হু করে বাড়ে, তখন আপনারটাই শুধু কমেছে। যেটুকু ছিল তাও বিলিয়ে দিয়ে সব সময় ডুবে থাকতেন বইয়ের মধ্যে।
প্রিয় আশরাফ ভাই, বাংলাদেশের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির ছেলে আপনি, সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রায় এক দশক, পাঁচবারের এমপি, তিনবারের মন্ত্রী। কিন্তু এতো কিছুর পরেও নিজের চিকিৎসার জন্য শহরের বাড়িটা বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আপনি সৈয়দ আশরাফ বলেই এটা সম্ভব। রাজনৈতিক সততার উজ্জ্বল ও বিরল এক দৃষ্টান্ত আপনি সৈয়দ আশরাফ।
আশরাফ ভাই, মাত্র ১৯ বছর বয়সেই আপনি যোগ দিয়েছিলেন ৭১ এর মহান মুক্তিসংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেছেন সবসময়। সততা ও আদর্শের সাথে কোনরকম ছাড় না দিয়ে সত্যিকারের রাজনৈতিক আদর্শের পুরোপুরি চর্চা করেছেন। কোনদিন কাউকে অসম্মান করে কথা বলেননি। এমনকি বিরোধী দলকেও না।
প্রিয় আশরাফ ভাই, আপনি তখন জনপ্রশাসন মন্ত্রী। বিসিএস সংক্রান্ত একটা নিউজে আপনার বক্তব্য নেয়ার জন্য আপনার বেইলি রোডের বাসার সামনে সারাদিন দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর আরো কতো জায়গায় ঘুরে না পেয়ে অফিসার্স ক্লাবে ময়মনসিংহ সমিতির এক অনুষ্ঠানে আপনার কাছে গিয়েছিলাম। আপনি সেদিন আমার প্রশ্ন শুনলেও উত্তর না দিয়ে শুধু হেসে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছিলাম আপনি উত্তর না দিলেও যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এই না হলে নেতা!
আশরাফ ভাই, শাকিল ভাই আপনার কথা বলতেন খুব। আপনার অনেক গল্প শুনেছি সাবেক সহকর্মী প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি Jahangir Alam ভাইয়ের মুখে। আপনার গল্প শুনেছি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ভৈরবের এমরান ভাই ও সাংবাদিক Hasan Jahid Tusher ভাইয়ের কাছে যিনি এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব। সবার কাছে গল্প শুনে প্রায়ই মনে হতো, যদি আপনার সাথে কোন একদিন গল্প করে কাটিয়ে দিতে পারতাম!
অাশরাফ ভাই, ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর আপনাকে নিয়ে লিখেছিলাম, আমাদের রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, পুলিশ, আইনজীবী, বিচারক, প্রকৌশলী, সরকারি কর্মচারী, উন্নয়ন কর্মী, ব্যবসায়ী সব পেশার মানুষেরই সততা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, পেশাদারিত্ত্ব দিনকে দিন নামছে। কমতে কমতে এমন অবস্থা যে এখন আর অনুসরণ করার মতো খুব বেশি কাউকে পাওয়া যায় না।
তবে এই নষ্ট সমাজেও আপনি সৈয়দ আশরাফের মতো মানুষ ছিলেন। তবে খারাপ মানুষের চাপে আপনারা পিষ্ট। সমাজের চোখে আপনারা কখনো মাতাল, কখনো বোকা, কখনো ব্যর্থ কখনো আবেগি। তবে আপনাদের মতো বোকা আবেগিরা আছে বলেই এখনো এই দেশটা টিকে আছে। আমি চাই এই দেশে আরো দুই একজন সৈয়দ আশরাফের সংখ্যা বাড়ুক।
আশরাফ ভাই শুনে খুব আপ্লুত হয়েছিলাম, আমার ফেসবুকের সেই লেখাটা আপনাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন আপনার বড় বোনের এক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বন্ধু পলি আপা। সেই লেখা পড়ে হয়তো মুচকি হেসেছিলেন। কিন্তু এই দেশ স্বাক্ষী আপনার মতো নেতা বিরল।
আশরাফ ভাই, ২০১৬ সালের কাউন্সিলের আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে আপনাকে সরিয়ে দেয়া, এরপর দলীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে কোনটাই আমার ভালো লাগেনি। আমি বলবো আপনি কষ্ট পেয়েছিলেন ভীষণ কিন্তু হাসিমুখে সব মেনে নিয়েছিলেন। তবে ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিলেন। এরপর স্ত্রীর মৃত্যু আপনাকে আরো নিঃসঙ্গ করল। সেই নিঃসঙ্গতা নিয়েই সবার অগোচরে চলে গেলেন দুই বছরে আগে আজকের দিনে।
আশরাফ ভাই আওয়ামী লীগের ২০১৬ সালের কাউন্সিলে আপনার বলা কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। আপনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ঘরে আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যখন ব্যথা পায়, আমারও কিন্তু হৃদয়ে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগের একটা কর্মী যদি ব্যথা পায় সেই ব্যথা আমিও পাই। আপনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়। হাজারো শহীদের রক্ত, জাতির পিতার রক্ত, জাতীয় চার নেতার রক্ত, হাজার হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ। আওয়ামী লীগ একটা অনুভূতি।
প্রিয় আশরাফ ভাই, বুকের মধ্যে কতটা ভালোবাসা থাকলে এমন ভাবে কথা বলা যায় সেটা অনেকেই বুঝবে না। আশরাফ ভাই, দোয়া করি ভালো থাকেন পরপারে। বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতাসহ সবাইকে আল্লাহ ভালো রাখুন। আজকে দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আপনাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আপনার মত রাজনীতিবিদকে স্যালুট।
শরিফুল হাসানের ফেসবুক থেকে